৫-যাকাত
link ইসলামিক ফাউন্ডেশন রাঙ্গামাটি যাকাত ক্যালকুলেটর
যাকাত বিষয়ে আলোচনা source: https://www.facebook.com/groups/hanafifiqhbd/posts/1886389178856057/
▬▬▬▬▬▬▬▬▬▬
যাকাত একদিকে যেমন আল্লাহর হক, অন্যদিকে তা বান্দারও হক। অথচ যত পার্সেন্ট মুসলিম নামায পড়ে, তারা সকলে যাকাত আদায় করে না। আবার যারা যাকাত দেয়, তারা সকলে সঠিকভাবে হিসাব করে দেয় না। তাই আমরা যাকাতের মাসআলা জেনে সঠিকভাবে যাকাত আদায়ের চেষ্টা করি।
◑ যাকাতযোগ্য সম্পদ পাঁচ ধরণের
▬▬▬▬▬▬▬▬▬▬▬▬▬▬
১. স্বর্ণ-রুপা ২. টাকা-পয়সা ৩. ব্যবসায়িক পণ্য ৪. পশু-জন্তু ৫. উশরী জমি।
প্রথম প্রকারের ব্যাখ্যা:
স্বর্ণ-রুপা গয়না হোক বা না হোক, ব্যবহার হোক বা না হোক। সোনা-রুপার সামগ্রী, কাপড় বা লেইস ইত্যাদি।
দ্বিতীয় প্রকারের ব্যাখ্যা:
মৌলিক প্রয়োজন বাদে উদ্বৃত্ত টাকা নেসাব পরিমাণ হলে। চাই তা জমা থাকুক বা ব্যবসায় খাটানো হোক, ব্যাংকের ব্যক্তি মালিকানাধীন সকল প্রকার একাউন্ট। কারেন্ট, সেভিংস, ডিপোজিট, ফিক্সড ডিপোজিট, লকার, লাইফ ইন্সুইরেন্স সহ সব ধরণের একাউন্ট, এফডিআর এবং সিকিউরিটি মানি, এডভান্সের টাকা (যা পরে ফেরত পাবে) ও প্রভিডেন্ট ফান্ড (যেটা বাধ্যতামূলক নয়), এমনকি হজ্ব, বাড়ি নির্মাণ ও বিয়ের জন্য জমা করা হলেও।
◑ বায়না নামার টাকার মালিক বিক্রেতা। তাই এগুলো বিক্রেতার মালিকানার সাথে হিসাব হবে এবং তার উপর উপর যাকাত আসবে।
◑ ঋণ বা বিক্রিত পণ্যের বকেয়া টাকার যাকাত ঋণদাতা ও বিক্রেতার উপর আসবে।
◑ স্বামীর কাছে পাওনা মোহরানা স্ত্রীর হস্তগত হওয়ার আগ পর্যন্ত তাতে যাকাত ফরয হয় না।
◑ পেনশনের টাকা হস্তগত হলে যাকাত দিতে হবে, যদিও উত্তলন না করা হয়।
তৃতীয় প্রকারের ব্যাখ্যা:
দোকান বা অন্য কোথাও রাখা ব্যবসায়িক পণ্য হিসেবে যা কিছুই থাকুক না কেন, যেমন ব্যবসার নিয়তে জমি বা ফ্ল্যাটের ন্যায় স্থাবর কোনোকিছু ক্রয় করলে অথবা মুদি সামগ্রী, কাপড়, স্বর্ণ-রুপা, গরু-ছাগল, গাড়ি, ফ্রিজ, মোবাইল, কম্পিউটার, বই বা ফার্ণিচারের ন্যায় অস্থাবর কোনোকিছু ক্রয় করলে।
◑ মিল/কারখানা, বিল্ডিং, ভাড়ার ফ্ল্যাট অথবা প্লটের উপর যাকাত না আসলেও উৎপাদিত পণ্য, কাঁচামাল ও আয়ের উপর যাকাত আসবে।
★ প্রশ্ন: ব্যবসায়িক পণ্যের মূল্য তো তিন ধরনের: খুচরা, পাইকারি, গড় মূল্য, তাহলে কোনটা দিবে?
উত্তর: পাইকারি মূল্য উত্তম, তবে গড় মূল্যও দিতে পারবে।
★ প্রশ্ন: মূল্য কোন দিনের ধরা হবে?
উত্তর: যাকাত আদায়ের দিনের।
যাকাত ফরয হওয়ার জন্য পাঁচ শর্ত
▬▬▬▬▬▬▬▬▬▬▬▬▬▬
প্রথম শর্ত:
সুস্থ মস্তিষ্ক, বালেগ, মুসলিম হওয়া।
দ্বিতীয় শর্ত:
মৌলিক প্রয়োজন উদ্বৃত্ত নেসাবের মালিক হওয়া। অর্থাৎ নিত্যপ্রয়োজনের অতিরিক্ত যাকাতযোগ্য সম্পদ তথা স্বর্ণ-রূপা, টাকা পয়সা, ব্যবসায়িক পণ্য ইত্যাদি নেসাব পরিমাণ থাকা।
আর মৌলিক প্রয়োজনের বস্তু দ্বারা উদ্দেশ্য হল, যা জীবনধারণকে সংকটময় করা থেকে নিরাপদ করে। যেমন: খাবার-দাবার, বসবাসের ঘর, ফ্রিজ, ব্যবহারের মোবাইল ও কম্পিউটার, সমরাস্ত্র, শীত ও গরম থেকে বাঁচার প্রয়োজনীয় পোশাক ইত্যাদি। অথবা সংশ্লিষ্ট পেশার হাতিয়ার বা আসবাবপত্র, বাহন-জন্তু, জ্ঞানী সমাজের প্রয়োজনীয় বই।
একথা স্বতসিদ্ধ যে, সবার প্রয়োজন এক পর্যায়ের হয় না। যেমন যে ব্যক্তি আলেম নয়, তার জন্য ইলমী কিতাব মৌলিক প্রয়োজনের অন্তর্ভুক্ত নয়। তেমনিভাবে, কারো নিকট মেহমান বেশি আসে। তাই অনেক বিছানাপত্র তার প্রয়োজনের অন্তর্ভুক্ত। কিন্তু অন্যের ক্ষেত্রে তা প্রয়োজনের অতিরিক্ত বিবেচিত হবে। মোটকথা, ঐসব আসবাবপত্র, যেগুলো কখনো ব্যবহারের সুযোগই আসে না বা আসলে বৎসরে দু' এক বার, তা নিত্যপ্রয়োজনের অতিরিক্ত।
নেসাব
▬▬▬
নেসাব হলো, সাড়ে সাত ভরি স্বর্ণ ও সাড়ে বায়ান্ন তোলা রূপা।
◑ টাকা-পয়সা ও ব্যবসায়িক পণ্যের ক্ষেত্রে রূপার নেসাব তথা সাড়ে বায়ান্ন তোলা রুপার মূল্য হিসাব করবে। যেমন রূপার তোলা যদি ১৫০০ টাকা হয়, তাহলে ৭৮ হাজার ৭৫০ টাকা নেসাব হবে।
◑ কিছু স্বর্ণ আর কিছু টাকা থাকলে সাড়ে বায়ান্ন তোলা রূপার সমতুল্য হলে যাকাত আসবে।
উল্লেখ্য, কিছু টাকা বলতে যা মাসিক প্রয়োজনের বেশি হবে। যেমন ৫ হাজার টাকা চেয়ে বেশি জমা থাকা।
তৃতীয় শর্ত:
সম্পদগুলোর উপর এক বছর অতিবাহিত হওয়া। তবে চাইলে অগ্রিম দিতে পারবে।
◑ বছরের শুরু ও শেষে নেসাব পূর্ণ থাকলে যাকাত দিতে হবে অর্থাৎ বছরের মাঝে ও শেষে যা যোগ হবে, সেগুলোর উপর বছর পূর্ণ হওয়া লাগবে না।
◑ বছরের হিসাব আরবি মাস এবং যে মাস থেকে মালিক হবে তখন থেকে শুরু ধরতে হবে, ইংরেজি মাস বা রমযান মাস থেকে শুরু নয়। আর যেদিন/তারিখ নেসাবের বছর পূর্ণ হবে, তখন থেকে ধরতে হবে।
উল্লেখ্য, অনেকে শুধু রমযানকে যাকাতের বছর মনে করেন, আবার এর জন্য কোন নির্দিষ্ট দিন বা তারিখ ঠিক করেন না। ফলে সঠিকভাবে পূর্ণাঙ্গ যাকাত আদায় হয় না। বরং কিছু যাকাত জিম্মায় থেকে যায়। তাই বছরের যেকোনো তারিখকে নির্দিষ্ট করতে হবে। এবং ঐদিন যত সম্পদের মালিক হবে, এগুলোর হিসাব করে যাকাত দিতে হবে।
চতুর্থ শর্ত:
নেসাবের ক্ষেত্রে সাধারণ ঋণ প্রতিবন্ধক না হওয়া।
ঋণ দুই প্রকার। ১. সাধারণ ঋণ, যা মোটামুটি স্বাচ্ছন্দে জীবনধারণের প্রয়োজনে করা হয়। ২. development ঋণ বা বড় লোকের ঋণ এবং স্ত্রীর মোহরানার ঋণ, যা সহসাই দেওয়ার ইচ্ছা নেই।
সাধারণ ঋণ যাকাতের ক্ষেত্রে প্রতিবন্ধক। অর্থাৎ যাকাতের হিসাবের ক্ষেত্রে এই প্রকার ঋণকে হিসাব করে মোট সম্পদ থেকে বিয়োগ করতে হবে।
আর ব্যাংক লোন/ডেভলপমেন্ট লোন প্রতিবন্ধক নয়। তবে চলতি বছরের আদায়যোগ্য লোন বিয়োগ করা যাবে। এ বিষয়ে আরো বিস্তারিতভাবে কোন বিজ্ঞ আলেমের থেকে জেনে নিবেন।
পঞ্চম শর্ত:
সম্পদ হালাল হতে হবে। কেননা হারাম সম্পদের উপর যাকাত আসে না। বরং তা মালিককে ফিরিয়ে দিতে হবে।
◑ হালাল ও হারাম সম্পদ মিশ্রিত থাকলে শুধু হালাল পরিমাণ সম্পদের উপর যাকাত আসবে।
যাকাত আদায় সহিহ হওয়ার জন্য এবং দায়মুক্ত হওয়ার জন্য শর্ত
▬▬▬▬▬▬▬▬▬▬▬▬▬▬▬▬▬▬▬▬▬▬▬▬▬▬
১. যাকাত প্রদানের সময় নিয়ত করা জরুরী। তবে পৃথক করে রাখলে নতুন করে করতে হবে না।
◑ যাকাতের টাকা আদায়ের আগে চুরি বা নষ্ট হলে পুনরায় দিতে হবে।
২. স্বামী-স্ত্রী পরস্পরকে যাকাত দিতে পারবে না। এভাবে বংশগতভাবে নিজের উপরের ও নিচের দিকের কাউকে দিতে পারবে না। যেমন মাতা-পিতা, দাদা-নানা বা যারা তার জন্মের উৎস এবং নিজের ছেলে-মেয়ে, নাতি-নাতনি ও তাদের অধস্তনকে দেওয়া যাবে না।
তবে মেয়ের জামাই ও ছেলের বউকে দিতে পারবে এবং আপন ভাই, বোন, ভাতিজা, ভাগ্নে, চাচা, মামা, ফুফু, খালা ও অন্যান্য আত্মীয় যাকাতের উপযুক্ত হলে দেওয়া যাবে।
৩. নির্দিষ্ট খাত তথা আটটি খাতে দিতে হবে।
◑ নির্দিষ্ট খাতের ব্যক্তির কাছে যাকাতযোগ্য সম্পদ নেসাব পরিমাণ নেই, কিন্তু অন্যান্য সম্পদ, যেমন- ঘরের আসবাবপত্র, পরিধেয় বস্ত্র, জুতো, গার্হস্থ সামগ্রী ইত্যাদি প্রয়োজনের অতিরিক্ত আছে, যার মূল্য সাড়ে বায়ান্ন তোলা রুপার সমপরিমাণ হয়ে যায়, তাকেও যাকাত দেওয়া যাবে না। তবে এ ব্যক্তির ওপর কুরবানী ও সদকায়ে ফিতর ওয়াজিব।
সারকথা, যার উপর কোরবানি ও সাদকায়ে ফিতর ওয়াজিব, সে যাকাত খেতে পারবে না।
-
যে ব্যক্তির কাছে যাকাতযোগ্য সম্পদ নেসাব পরিমাণ নেই, কিন্তু অন্যান্য সম্পদ, যেমন- ঘরের আসবাবপত্র, পরিধেয় বস্ত্র, জুতো, গার্হস্থ সামগ্রী ইত্যাদি প্রয়োজনের অতিরিক্ত আছে, যার মূল্য সাড়ে বায়ান্ন তোলা রুপার সমপরিমাণ হয়ে যায়, তাকেও যাকাত দেওয়া যাবে না। এ ব্যক্তির ওপর কুরবানী ও সদকায়ে ফিতর ওয়াজিব। (আল-মুহীতুল বুরহানী ৩/২১৬)
-
যে ব্যক্তি এমন ঋণগ্রস্ত যে, ঋণ পরিশোধের পর তার কাছে নেসাব পরিমাণ সম্পদ থাকে না, তাকে যাকাত দেওয়া যাবে। (আল-মুহীতুল বুরহানী ৩/২১০)
৪. মুসলমানকে দিতে হবে। কাজেই কোন কাদিয়ানী, হিজবুত তাওহীদ, সেক্যুলার বা ডেমোক্রেসির প্রকৃত অর্থে ধর্মনিরপেক্ষতাবাদী ও গণতন্ত্রপন্থীকে যাকাত দিলে আদায় হবে না।
৫. প্রাপ্তবয়স্ক ও বুঝমানকে দিতে হবে। তবে যেই অপ্রাপ্তবয়স্ক বুঝমান ছেলে-মেয়ের পিতা যাকাত গ্রহণের উপযুক্ত, সেই ছেলে-মেয়েকে দেওয়া যাবে।
৬. পারিশ্রমিক হিসেবে দিতে পারবে না। যেমন কাজের লোককে, ইমাম-মুয়াজ্জিনকে। তবে আত্মীয়-স্বজন ও দ্বীনদার ব্যক্তি যাকাতের উপযুক্ত হলে, তাদেরকে দেওয়া উত্তম।
৭. যাকাত গ্রহণকারীর মধ্যে মালিক হওয়ার যোগ্যতা থাকতে হবে এবং দেওয়ার সময় তাকে পূর্ণ মালিক বানিয়ে দিতে হবে।
◑ তাই মৃত ব্যক্তির কাফন-দাফন, জনকল্যাণ মূলক কাজ, মসজিদ মাদরাসা নির্মাণ, টিভি চ্যানেলের জন্য যাকাত দিলে আদায় হবে না। এবং পাওনা ঋণের টাকা যাকাত হিসেবে কর্তন করলে আদায় হবে না।
৮. আরবি বছর হিসেবে দিলে শতকরা ২.৫% দিতে হবে। আর ইংরেজি বছর হিসেবে দিলে ২.৬% দিতে হবে।
◑ বিকাশের মাধ্যমে দিলে খরচ নিজেকে বহন করতে হবে।
◑ যাকাতের জন্য নিম্নমানের আলাদা কোন কাপড় শাড়ি লুঙ্গি ইত্যাদি নেই। তবে টাকা না দিয়ে ওই পরিমাণ ভালো মানের প্রয়োজনীয় সামগ্রী বা দরকারি কাপড়-চোপড় কিনে দিলেও যাকাত আদায় হবে।
মনে রাখবেন, যাকাত গরিবের উপর আপনার অনুগ্রহ নয়; বরং এটা তার হক, যা আপনার কাছে রয়েছে। কাজেই হকদারকে তার হক সম্মানের সাথে প্রদান করা উচিত।
শাইখ Sayed Ahmad হাফি.